সোমবার, ২৭ আগস্ট, ২০১২

চন্দ্রজয়ী সন্তান হারাল পৃথিবী

‘একজন মানুষের জন্য এটা ছোট একটা পদক্ষেপ, কিন্তু মানবজাতির জন্য বিশাল অর্জন’-চাঁদের বুকে প্রথম পা রেখে এই জ্ঞানগর্ভ উক্তি যে মানুষটি করেছিলেন সেই নীল আর্মস্ট্রং আর নেই। শনিবার চাঁদের এই মানবসন্তানটি ৮২ বছর বয়সে মারা গেছেন। চন্দ্রবিজয়ী সাবেক এই নভোচারীর মৃত্যুতে যুক্তরাষ্ট্রসহ গোটা বিশ্বের মানুষ রীতিমতো থমকে যায়। মানবজাতিকে মর্যাদার চরম শিখরে পৌঁছে দেওয়ার জন্য আবারও কৃতজ্ঞতা জানায় ধরণীর এই মহান বীর সন্তানের প্রতি। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা তার শোকবার্তায় নীল আর্মস্ট্রংকে সর্বকালের সেরা আমেরিকান হিসেবে বর্ণনা করেছেন। রিপাবলিকান দলীয় প্রেসিডেন্ট প্রার্থী মিট রমনি বলেছেন, চাঁদ তার পৃথিবীর এই প্রথম সন্তানকে সবসময় মনে রাখবে। এএফপি, রয়টার্স, বিবিসি।
পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, গত ৫ আগস্ট নিজের জন্মদিনের দু’দিন আগে আর্মস্ট্রংয়ের হার্টে বাইপাস সার্জারি করা হয়। হার্টের ব্লক দূর করতেই তার এই অস্ত্রোপচার। সেটি তিনি সামাল দিতে পারেননি। ঢলে পড়েন মৃত্যুর কোলে। তবে কোথায় তার মৃত্যু হয়েছে সে সম্পর্কে তার পরিবার কিছুই জানায়নি। যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ সংস্থা নাসার অ্যাপোলো-১১ মিশনের অধিনায়ক হিসেবে ১৯৬৯ সালের ২০ জুলাই চাঁদের বুকে মানুষের প্রথম পদচিহ্ন এঁকে দেন আর্মস্ট্রং। সঙ্গী এডউইন অলড্রিনের সঙ্গে প্রায় তিন ঘণ্টা তিনি চাঁদে বিচরণ করেন। ছবি তোলেন। বালি, পাথরসহ বিভিন্ন কিছু সংগ্রহ করেন। চাঁদের বুকে গেড়ে দেন মার্কিন পতাকা, যা আজও অক্ষত আছে।  অপর সঙ্গী মাইকেল কলিন্স বসে ছিলেন চন্দ্রযানটিতে। নাসার এই চন্দ্রজয়ের দৃশ্য তখন টেলিভিশনে সরাসরি প্রচার করা হয়। সারা বিশ্বের প্রায় ৫০ কোটি লোক সেই অবিশ্বাস্য দৃশ্য সরাসরি প্রত্যক্ষ করে। আর্মস্ট্রং চাঁদে পা রেখে বলে ওঠেন, একজন মানুষের জন্য এটি একটি ছোট পদক্ষেপ, কিন্তু মানবজাতির একটি ‘বিশাল অগ্রগতি’। নীল আর্মস্ট্রংয়ের জন্ম ওহাইওতে ১৯৩০ সালের ৫ আগস্ট। বাবার সঙ্গে ছয় বছর বয়সে বিমানে ওঠেন। ১৬ বছর বয়সেই বিমান চালানো শিখে ফেলেন। গাড়ি চালানোর লাইসেন্স পাওয়ার আগেই রপ্ত হয়ে যায় বিমান চালানোর কায়দা। ১৯৫০-এর দশকের শুরুতে কোরীয় যুদ্ধের সময় নৌবাহিনীর ফাইটার জেট চালিয়েছেন তিনি। ১৯৫২ সালে বিমানবাহিনী ছেড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের লেখাপড়ায় মন দেন। ১৯৬২ সালে যোগ দেন মার্কিন মহাশূন্য কর্মসূচিতে।আর্মস্ট্রংয়ের মহাকাশ অভিযানের শুরু ৩৫ বছর বয়সে। ১৯৬৬ সালের ১৬ মার্চ মহাশূন্যযান জেমিনি-৮-এ সেই অভিযানে তার সঙ্গী ছিলেন ডেভিড স্কট। চন্দ্র অভিযানের পর বলতে গেলে নিভৃত জীবন কাটিয়েছেন তিনি। জনসম্মুখে এসেছেন কদাচিত্। অ্যাপোলো-১১ মিশনের পরের বছরই নাসা ছেড়ে দিয়ে সিনসিনাটি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রকৌশলের অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন আর্মস্ট্রং। স্ত্রী ক্যারলের সঙ্গে সিনসিনাটিতেই বসবাস করতেন তিনি। গত নভেম্বরে আরও তিন নভোচারীর সঙ্গে আর্মস্ট্রংকে যুক্তরাষ্ট্রের সর্বোচ্চ বেসামরিক পদক কংগ্রেশনাল গোল্ড মেডল দিয়ে সম্মানিত করা হয়। এক সাক্ষাত্কারে নীল আর্মস্ট্রং বলেছিলেন, আমার বিশ্বাস, প্রত্যেক মানুষের জন্য নির্দিষ্টসংখ্যক হূদস্পন্দন বরাদ্দ থাকে। আমি এর একটিও নষ্ট করতে চাই না। চন্দ্রবিজয়কে বলা হয় বিশ শতকে মানবজাতির সবচেয়ে বড় অর্জন। আর যার পায়ে ভর করে বিজয় এসেছিল, সেই আর্মস্ট্রংয়ের সঙ্গে এই পৃথিবীতে জন্ম নেওয়া প্রতিটি শিশুর পরিচয় ঘটবে পাঠ্যবইয়ের পাতায়। আর্মস্ট্রং আমেরিকার শ্রেষ্ঠ বীর নীল আর্মস্ট্রংয়ের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানিয়ে তাকে ‘সর্বকালের সেরা আমেরিকান’ অভিহিত করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা। তার মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছেন সেই চন্দ্রাভিযানের সহযাত্রী এডউইন অলড্রিন, মাইকেল কলিন্সসহ বহু মানুষ। প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা এক বিবৃতিতে বলেন, শুধু তার সময়েই নয়, সর্বকালের আমেরিকান বীরদের মধ্যে নীল সর্বশ্রেষ্ঠ। অজানাকে জানার জন্য আজ যারা নিবেদিত, তাদের সবার মধ্যে নীলের আবিষ্কারের নেশা ছড়িয়ে আছে। ... তার অবদান চির অম্লান থাকবে, যিনি আমাদের একটি ছোট্ট পদক্ষেপের মধ্যে নিহিত বিপুল ক্ষমতার কথা জানিয়ে গেছেন। অ্যাপোলো-১১ মিশনে অধিনায়ক আর্মস্ট্রংয়ের পর দ্বিতীয় মানুষ হিসেবে চাঁদে পা রেখেছিলেন এডউইন অলড্রিন। সাবেক সহকর্মীর মৃত্যুর খবরে তাত্ক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় তিনি বলেন, মহাশূন্য কর্মসূচির এক মহান নেতা ও মুখপাত্রের অভাববোধ করছি আমরা। স্মৃতি রোমন্থন করে অলড্রিন আরও বলেন, শুধু মঙ্গলের বুকে মানুষের পায়ের ছাপ পড়ার মাধ্যমেই তার কীর্তির তুলনা হতে পারে। তিনি ছিলেন অসাধারণ নেতা। সেই অভিযানের আরেক অভিযাত্রী মাইকেল কলিন্স বলেন, আমি বিষণ্নভাবে তার অভাব অনুভব করব। বিখ্যাত মার্কিন মহাকাশচারী ও ওহাইওর সাবেক সিনেটর জন গ্লেন বলেন, দেশের জন্য তিনি যে কোনো কিছু করতে প্রস্তুত ছিলেন। আর কিছু করতে পারলে সম্মানিত বোধ করতেন। সারা জীবন তিনি ছিলেন একই রকম বিনয়ী। নাসার প্রশাসক চার্লস বোল্ডেন বলেন, তিনি ছিলেন আমেরিকার অন্যতম শ্রেষ্ঠ অভিযাত্রী। চলাফেরায় ছিলেন অত্যন্ত সহজ, যা থেকে সৌন্দর্য ফুটে বের হতো। আমাদের সবার জন্য তিনি উদাহরণ। যখন প্রেসিডেন্ট কেনেডি একজন মানুষকে চাঁদে পাঠাবেন বলে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিলেন, কোনো দ্বিধা ছাড়াই এগিয়ে এসেছিলেন আর্মস্ট্রং। নীল আর্মস্ট্রংয়ের দুই কাঁধে ভর করেই মহাশূন্য অভিযানের নতুন যুগে প্রবেশ করতে যাচ্ছি আমরা। একজন বন্ধুর, একজন সহমহাকাশচারীর ও একজন প্রকৃত আমেরিকান বীরের মৃত্যুতে আমরা গভীরভাবে মর্মাহত।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন